Wellcome to National Portal
মেনু নির্বাচন করুন
Main Comtent Skiped

ঐতিহ্য

গরুর গাড়ীঃ

      এককালে যা কল্পনা করেনি তাই এখন পেয়ে যাচ্ছে হাতের নাগালে। ইট পাথরের মত মানুষও হয়ে পড়ছে যান্ত্রিক। মানুষ তার নিজস্ব ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলছে তারই ধারাবাহিকতায় হারিয়ে যাওয়ার পথে এক সময়ের যোগাযোগের প্রধান অবলম্বন গরুর গাড়ি। পায়ে হাঁটার যুগের অবসান হওয়ার পর মানুষ যখন পশুকে যোগাযোগের মাধ্যমে হিসাবে ব্যবহার করতে শিখলো তখন গরুর গাড়িই হয়ে উঠেছিল সকল পথের যোগাযোগ ও পণ্য পরিবহনের প্রধান মাধ্যম। পণ্য পরিবহনের পাশাপাশি বিবাহের বর-কনে বহনের ক্ষেত্রেও গরুর গাড়ি কোন বিকল্প ছিলনা। 
কিন্তু কালের বিবর্তনে এই গরুর গাড়ি আজ হারিয়ে যাওয়ার পথে। অনুসন্ধানভেদে কিছু কিছু জায়গায় পণ্য পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হলেও বিবাহের বর-কনের পরিবহনের জন্য গরুর গাড়ির কথা যেন আর চিন্তাই করা যায় না। অনেকের কাছেই একটি যেন অসম্মানজনক হয়ে পড়েছে। এক সময় গ্রামবাংলায় কৃষকের ঘরে ঘরে শোভা পেত নানা ডিজাইনের গরুর গাড়ি। গরুর গাড়িতে টোপর দিয়ে মানুষ এক স্থান থেকে অন্যস্থানে চলাচল করতো। টোপর বিহীন গরুর গাড়ি ব্যবহার হতো মালামাল পরিবহন, ব্যবসা, ফসল ঘরে তোলা বা বাজারজাতকরণের জন্য। যান্ত্রিক আবিস্কার ও কৃষকদের মাঝে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগার কারণে গরুর গাড়ির স্থান দখল করে নিয়েছে ভ্যান, অটোরিকশা, নছিমন-করিমন, ভটভটি, বাস, ট্রাক ইত্যাদি।

 

       ওকি গাড়িয়াল ভাই, হাঁকাও গাড়ী তুই চিলমারির বন্দরে--- বিখ্যাত এ গান এখনো কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে শোনা গেলে হৃদয়ে ভেসে উঠে গরু-মহিষের গাড়ী হাঁকিয়ে যাওয়ার দৃশ্য। কিন্তু গান থাকলেও, নেই সেই আগের গরু মহিষের গাড়ী, নেই গাড়িয়াল। নেই হৈ হৈ রৈ রৈ হাঁক ডাক, নেই গাড়ির চাকার ক্যাচ ক্যাচ শব্দ। গরুর হাম্বা অথবা গলা ঝোলানো ঘন্টার টুং টাং আওয়াজ। গরুর গাড়ির পরিবর্তে যান্ত্রিক নছিমন, করিমন, আগলামন, বাস, ট্রাকসহ বিভিন্ন যন্ত্র যানের কারণে আজ জাদুঘরে স্থান হতে চলেছে গরুর গাড়ী। বংশ পরম্পরায় গাড়িয়ালরা জীবন জীবিকার তাগিদে পরিবর্তন করেছে পেশা। এদের কেউ শহরে মজুর খাটছে, আবার কেউবা রিক্সার হেন্ডেল ধরেছে, কেউ অন্যকোন পেশায় নিয়োজিত। 
বৃহত্তর কুষ্টিয়া অঞ্চলে গরু মহিষের গাড়ির প্রচলন আদিকাল থেকেই। গরুর গাড়িতে বিয়ে, বরযাত্রী, মালামাল পরিবহন, নাইয়রি আনা নেয়া ইত্যাদি এক সময় হতো খুব জাঁকজমকের মধ্য দিয়ে। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় শোভা পেতো এই দু' চাকার গাড়িটি। এক সময় বৃহত্তর কুষ্টিয়ার যে কোন গ্রামে অবশ্যই চোখে পড়তো গরু কিংবা মহিষের গাড়ী। সেই দৃশ্য খুব একটা এখন চোখে পড়ে না।
          প্রত্নতাত্বিক গবেষণা গ্রন্থ ও বাংলা বিশ্বকোষ সূত্রে জানা গেছে, ব্রোঞ্জ যুগের পূর্ব গোলার্ধে কুমারের চাকা এবং গাড়ির শঠিন কাষ্ঠ নির্মিত চাকাটির মতো চাকা সর্বপ্রথম মানুষ ব্যবহার শুরু করে। মিশরীয় ব্যবিলন এবং ভারতের সভ্যতায় চাকাওয়ালা গাড়ি ছিল। এ থেকে ধারণা করা যায় চাকার প্রাথমিক আবিষ্কার ৬ হাজার বছর আগে। ৬ হাজার বছর আগে কাঠ, পাথর, মালপত্র এবং অন্যান্য জিনিসপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া হতো ঢালু পথে গোলাকৃতি কাঠের গুঁড়ির ওপর দিয়ে। এই কাঠের গুঁড়ি থেকে মানুষের মাথায় চাকার ধারণা আসে। একটি বসবার জায়গা তৈরি করে তার দুদিকে দুটো চাকা জুড়ে দিয়ে তৈরি করা হয় গাড়ির প্রচলন। এক সময় গাড়ি টানার জন্য ব্যবহৃত হতো গরু, মহিষ, ঘোড়া, কুকুর ও মানুষ। এ সময় গরুর গাড়ির চাকায় লৌহ আবরন ছিল না কেবল কাঠ দ্বারা নির্মিত হতো। দ্রারিড় যুগে যখন এ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে তখন থেকে লোহার ব্যবহার চালু হয়। ১৬৪৬ সালে বাই সাইকেলের আবিষ্কার, ১৮২৬ সালে রেল ইঞ্জিন আবিষ্কার, এর পরে মটর গাড়ি বাস, ট্রাক, মটরসাইকেল শ্যালো চালিত যান ইত্যাদি আবিস্কার হলে পুরনো যানবাহনের যায়গা দখল করে নেয়। কিছুদিন আগেও এ অঞ্চলে গরুর গাড়ির ক্যাচ ক্যাচ শব্দে মুখরিত ছিল চার পাশ। গরুর খুড়ার ধুলি গৃহস্থলের হাক ডাক ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। 
        চাকা তৈরি কারিগর মিজান শেখ জানান, আগে হাটে চাকার চাহিদা অনেক ছিল। বিভিন্ন এলাকা থেকে চাকা কিনতে আসত। কিন্তু একযুগ ধরে এই চাকার চাহিদা কমে যায়। এখন যান্ত্রিক যুগের কারণে গরুর গাড়ির চাকা বিক্রি হয় না। 
মিজান শেখ এখন দিন মজুরির কাজ করে। গরু মহিষের গাড়ি এখন আবহমান গ্রাম বাংলা থেকে বিলীন হয়ে যেতে বসেছে। গরু মহিষের গাড়ি দেখানোর জন্য আগামী প্রজন্মকে জাদুঘরে যেতে হতে পারে।

 

পালকিঃ

     কালের বিবর্তনে কতো কিছু পাল্টায়—পাল্টায় সংস্কৃতি, সভ্যতা সেই সঙ্গে পাল্টে যায় মানুষের জীবনধারা। এ পরিবর্তনের রেশ ধরেই হারিয়ে যায় সংস্কৃতির সুপরিচিত অনেক পুরনো ঐতিহ্য। এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের মধ্যে পালকি অন্যতম। 
‘পালকি চলে, পালকি চলে, গগনতলে আগুন জ্বলে’... তাছাড়া আরো সুন্দর ছন্দবদ্ধ কথা ‘... তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে ...।’ পালকি আমাদের দেশের জাতি, ধর্ম, বর্ণ সবার কাছে সমান পছন্দনীয় ছিলো। এটি আমাদের দেশের হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য। পালকি নিয়ে লেখা হয়েছে গান, ছড়াসহ কতো শত কবিতা। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেক কবি পালকি নিয়ে লিখেছেন।
এক কালে এদেশের জমিদার-নবাবসহ সমাজের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা কোথাও যাতায়াত করলে পালকি ছাড়া চলতোই না যেন। তাদের সামান্য পথটুকু চলতেও পালকি লাগতো। যেমন—তাদের খাসমহল থেকে ঘোড়ার পিঠ পর্যন্ত বা পানসি ঘাট পর্যন্ত যেতেও পালকি ব্যবহার করা হতো। এ তো গেলো এক শ্রেণীর লোকদের কথা। এরা ছাড়াও সমাজের জ্ঞানী-গুণী মানুষদের বরণ করতে তত্কালে পালকির বিকল্প যেন পালকিই ছিলো। সে আমলে বিদেশি কোনো মেহমান এলেও তাকে পালকিতে চড়িয়ে বরণ করা হতো। যেমনটা করা হয় বর্তমান দিনে অতিথিদের সম্মানে মোটর শোভাযাত্রায়। সে যা হোক, পালকির কথা সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছেন বিশ্ববিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার এদেশে আসা ভ্রমণ কাহিনীতে। তার লেখার মধ্যে এ কথাও পাওয়া যায় যে, তিনি পালকি বহনের দৃশ্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন।


            তখনকার দিনের বিয়ে এবং পালকি এ যেন ছিলো একই সুতোয় গাঁথা। আমাদের দেশে এমন এক সময় গেছে যখন বিয়ের অনুষ্ঠান পালকি ছাড়া হতোই না, পালকি ছাড়া বিয়ে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলে যেন নিজেদের হতভাগা বলে মনে করা হতো। নতুন বউ তুলে দেয়া হতো বরের বাড়িতে পালকিতে করে। আবার এ বিয়ে উপলক্ষে পালকি সাজানো হতো মনোলোভা ও দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্যে। সব পরিবারে আবার পালকি ছিলো না। তখনকার দিনে বিত্তশালী ও উচ্চবংশীয় লোকদের প্রত্যেকের বাড়িতে পালকি ছিল বংশের মর্যাদার প্রতীক। সাধারণ পরিবারের লোকদের বাড়িতে পালকি ছিল না বললেই চলে। তাই বলে তাদের উত্সব পার্বণ পালকি ছাড়া হতো তা কিন্তু নয়। তাদের জন্য অন্য ব্যবস্থা ছিলো। সে সময়ে কিছু কিছু মানুষ এ পালকি নিয়ে বাণিজ্য করতো, মানে পালকি বানিয়ে অর্থের বিনিময়ে চুক্তিতে দিতো। এ জন্য পালকি মালিকদের দিতে হতো মোটা অংকের কড়ি বা টাকা অথবা তার সমতুল্য অন্য কোনো জিনিস।
 

পালকিকে ঘিরে আরো কিছু লোক জীবন-জীবিকা নির্বাহ করতো। এ লোকদের বলা হতো ‘কাহার’ বা ‘বেহারা’ যেদিন তাদের দরকার হতো  তার আগে ‘বায়না’স্বরূপ মাইনে দিতে হতো। বিয়ের অনুষ্ঠানের দিন বিয়ে বাড়িতে তাদের খাওয়ানো হতো জামাই আদরে। এছাড়া তাদের সম্মানী দিতে হতো বরপক্ষ থেকে।
            মেয়ে বাবার বাড়িতে নাইওর যেতেও ব্যবহার করতো পালকি। পালকিতে চারজন বেহারা বা কাহার প্রয়োজন হতো। গ্রামগঞ্জে অন্যান্য লোকালয়ে পালকিতে করে বউ নেয়া, দৃশ্য চোখে পড়তো। পালকির দরজার ফাঁক দিয়ে নতুন বউটি বাইরে দৃষ্টি দিতো কান্না ভেজা চোখে। যখন বেহারারা বউ নিয়ে যেত গ্রাম থেকে গ্রাম পেছনে ফেলে, তখন তাদের কণ্ঠে চলতো পালকি বহনের গান—‘হুন হুনা হুন হুনরে’ বা ‘চার বেহারার পালকি চড়ে যায় রে কন্যা পরের ঘরে।’ আরো এরকম হৃদয় ছোঁয়া গানে গ্রামগঞ্জ যেন জেগে উঠতো নতুন প্রাণে। তাদের পালকি বহনের সময় পা ফেলার আলাদা তাল বা ছন্দ ছিলো। সেই ছন্দ আর তালের সঙ্গে নিজস্ব গানে গানে কাঁধে নিয়ে বইতো পালকি।
           

এখন আর গ্রামগঞ্জ, শহর, বন্দরে দেখা যায় না পালকি বহনের দৃশ্য। পালকি এখন স্থান পেয়েছে জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য। পালকির সেই ঐতিহ্যময় ব্যবহার ক্রমে গ্রাস করেছে যান্ত্রিক সভ্যতার বিদেশি নানান রংয়ের বাহারি গাড়ি। পালকি বহনের দৃশ্য এখন যেন স্বপ্ন। সেই সঙ্গে হারিয়ে গেছে ছন্দমাখা পালকি বহনের গান।